জীবনভর গবেষণা করেছি। সব সময় ভাবতাম, আমি তো অনেক কিছু পেয়েছি, দেশের জন্য আমারও কিছু করা উচিত। দেখতাম, গবেষণা খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ কম এখানকার মানুষের। আমার কম্পিউটারে সব সময় অনেক ফোল্ডার থাকত।
আমার স্বপ্ন-পরিকল্পনা থাকত তাতে। আমার হাজব্যান্ড অধ্যাপক সাইয়াদ সালেহীন কাদরী এবং সন্তানদের সঙ্গে শেয়ার করতাম—কী করতে চাই।
২০১২ সালে ফ্রেঞ্চ একাডেমিক সায়েন্সের গ্র্যান্ড প্রাইজ পেলাম। প্রাইজ মানি পাঁচ লাখ ইউরো। অর্থের প্রতি কোনো মোহ ছিল না আমার হাজব্যান্ডের। একদিন তাঁকে বললাম, এমন একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান করতে চাই যেখানে বিশ্বমানের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। বললেন, পাঁচ লাখ ইউরো পেয়েছ, পুরোটাই খরচ করতে পারো। তখন পুরো টাকাটা বিনিয়োগ করলাম।
শুরুর দিনগুলো
আইদেশির যাত্রা শুরু ২০১৪ সালে। প্রথমে জায়গা ছিল না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ডিজি হেলথ এবং ইউনিভার্সিটির সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করলাম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেন্টার ফর মেডিক্যাল বায়োটেকনোলজিতে (সিএমভিটি) আমাকে তিনটি রুম দেওয়া হলো। নতুন করে সেগুলো সাজালাম। যন্ত্রপাতি কিনলাম। পুরস্কারের টাকার বাইরে আরো অনেক টাকা লাগল। সিএমভিটিতে অনেক কাজ করলাম। তাঁদের কোর্স নিতাম। দেশের সব জায়গা থেকে নবীন চিকিৎসকরা আসতেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতাম।
‘বেশি চিন্তা করবে না’
শুরু থেকেই আইসিডিডিআরবির সহযোগিতা পেয়ে আসছি। আমাদের বড় একটা বোর্ড রয়েছে। আইদেশির আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে যাঁদের বিশেষ অবদান রয়েছে, তাঁদের অন্যতম হলেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান, অধ্যাপক নইম চৌধুরী, অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ, অধ্যাপক শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক নারায়ণ, অধ্যাপক দীন মোহাম্মদ, অধ্যাপক এমরান কবির, আব্দুল মুক্তাদির প্রমুখ। প্রত্যেকে মনে করেছেন—ফিরদৌসী কিছু করতে চাচ্ছে, হয়ে যাবে। এম আর খান স্যার বললেন, ‘বেশি চিন্তা করবে না।’ আমরা বিএসএমএমইউতে বসতাম, স্যারের বাসায়ও বসতাম। চা-নাশতা খেতে খেতে প্ল্যান করতাম, কী করব। দেশে এমন একটা কাজ করার ইচ্ছা ছিল, যেটা কেউ করে না। জন্মগত রোগ বা জেনেটিক ডিস-অর্ডার নিয়ে জন্মানো বাচ্চাদের রোগ নির্ণয়ের কাজ। ঠিক করলাম, আমরা এখানে জনবল তৈরি করব। আমাদের যেসব গবেষক বিদেশ থেকে ফিরতে চান, তাঁদের একটা প্ল্যাটফর্ম দেব। যাঁরা পিএইচডি করতে চান, তাঁদের সুযোগ দেব।
ইন বর্ন এররস অব মেটাবলিজম
আইদেশি থেকে ২০টি পেপার প্রকাশিত হয়েছে। আমরা এরই মধ্যে এমন সব রোগ নিয়ে কাজ করেছি, যেটা বাংলাদেশে এত দ্রুত আর সুন্দরভাবে করা যায়—সম্ভবত এমনটা কেউ ভাবেনি। থ্যালাসেমিয়া নিয়ে অনেক কাজ করি। এটা আমাদের অন্যতম বড় জেনেটিক ডিস-অর্ডার। অন্যদিকে জন্মের সময় অনেক বাচ্চার মধ্যে জিন ডিফেক্ট থাকে। এ জন্য তারা দুধের একটা অ্যামাইনো এসিডকে ভাঙতে পারে না। ফলে শিশুর মেন্টাল রিটারডেশন হয়। কিন্তু এটা ডিটেকশনের কোনো ক্ষমতা ছিল না বাংলাদেশে। আমরা সেটা করেছি। এটা কোনো নতুন আবিষ্কার নয়। তবু বাংলাদেশে এটাকে এস্টাবলিশ করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির দামই তিন-চার কোটি টাকা। আরেকটা রোগ—ইন বর্ন এররস অব মেটাবলিজম। রোগ হলে শিশুর শরীর খাবারকে ঠিকঠাক শক্তিতে রূপান্তর করতে পারে না। বাংলাদেশে কিন্তু এটা নির্ণয় করা হতো না। আমরা করলাম।
আমরাই প্রথম রিপোর্ট করেছি
আইদেশির উদ্দেশ্য ছিল শুধু ঢাকা নয়, দেশের সব জায়গা থেকেই যেন ছেলে-মেয়েরা এখানে আসে। কুষ্টিয়ার ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করত মাহফুজ আল মামুন। বলল, ‘ম্যাডাম আমাদের গ্রামে একটা পরিবার আছে যারা সারাক্ষণ হাত-পা নাড়াতে থাকে। এরা আসলে কোন রোগে আক্রান্ত কেউ জানে না।’ আমরা তখন সবাই চলে গেলাম সেখানে। পরিবারের সবার তথ্য নিলাম। মুসলিম মিয়া নামে মাঝবয়সী এক ব্যক্তিকে ঢাকায় নিয়ে এলাম। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স এবং আইদেশিতে অনেক জেনেটিক টেস্ট করে আমরা রোগটি শনাক্ত করলাম। এটা হান্টিংটন ডিজিজ। ইউরোপিয়ান এই রোগটি যে বাংলাদেশে আছে কেউ জানত না। বাংলাদেশ থেকে এই রোগ নিয়ে আমরাই প্রথম রিপোর্ট করেছি। এ নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধ ছাপা হয় ক্লিনিক্যাল কেস রিপোর্টস জার্নালে। শিরোনাম ‘এক্সামিনেশন অব হান্টিংটন’স ডিজিজ উইথ অ্যাটিপিক্যাল ক্লিনিক্যাল ফিচারস ইন আ বাংলাদেশি ফ্যামিলি ট্রি’।
তারপর অন্যান্য জন্মগত রোগ নিয়ে কাজ শুরু করলাম। যেমন—হাইপোথাইরয়েডিজম। জন্মের পরই যদি এটা নির্ণয় করা যায় তাহলে বাচ্চার শারীরিক বৃদ্ধিজনিত সমস্যা হয় না। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় পরে সারানো কঠিন। থ্যালাসেমিয়া নিয়েও আমরা অনেক কাজ করেছি। থ্যালাসেমিয়া আপনি সবার মধ্যে দেখবেন না। কিন্তু অনেকে এর বাহক। একজন বাহকের সঙ্গে অন্যজনের বিয়ে হলে সন্তানের এটা হতে পারে। আমাদের এখানে রক্তের সম্পর্ক আছে এমন লোকজনের মধ্যে বিয়ে হয়। বিশ্বের অনেক জায়গায় এটা নিষিদ্ধ। শুধু থ্যালাসেমিয়া নয়, আরো অনেক রোগের জন্যই পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে বিয়ে না হলেই ভালো।
এখন সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছি কভিড নিয়ে গবেষণার ওপর। মার্চে দেশে যখন কভিড এলো তার আগে ডিসেম্বরে চীন গিয়েছিলাম। তখন সেখানকার একজন প্রফেসর জানিয়েছিলেন, ‘অনেক কঠিন একটা ভাইরাস আমরা আইডেন্টিফাই করেছি।’ তখন থেকে আমি তৈরি হলাম। তখন বাংলাদেশে হাতে গোনা কয়েকটি ল্যাব ছিল যেগুলোতে আরটিপিসিআর মেশিন ছিল। আইদেশি সেগুলোর একটা। এখানে বিএসএল টু প্লাস ল্যাব, প্রশিক্ষিত জনবল এবং চেষ্টা ছিল। তখন থেকে বাংলাদেশের সব জায়গা থেকে আমাদের কাছে স্যাম্পল আসতে লাগল। কভিড-১৯ রোগটির জিনোমিকস এবং সেরোলজি নিয়ে গবেষণায়ও অনেক এগিয়েছি। আইইডিসিআর, আইসিডিডিআরবি, হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল এবং ওয়েলকাম স্যানজার ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যৌথভাবে কাজটি করছি।
যেভাবে চলে
আমাদের কিছু দেশি-বিদেশি গবেষণা প্রজেক্ট আছে। কিছু ডায়াগনোসিসও করি। কভিড-১৯ এবং ইন বর্ন এররস অব মেটাবলিজম টেস্টও করছি। এভাবেই চলছে প্রতিষ্ঠান। এখন ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প মিলিয়ে ৫০ জনের মতো কর্মরত আছে। মাহফুজ, সুপ্রভাত, ড. রোজী, ফারজানা, নুসরাত, মালিহাসহ অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পিএইচডি এবং পোস্ট ডক করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, আইইউবিসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ইন্টার্নশিপ করেছে।
এবার স্থায়ী ঠিকানায়
আমি আইসিডিডিআরবিতে ইমেরিটাস সায়েন্টিস্ট। ইমেরিটাস হতে গেলে অবসরকালীন ফান্ডটা নিয়ে নিতে হয়। এরই মধ্যে লরিয়েল-ইউনেসকো থেকে প্রাইজমানি হিসেবে পেলাম ওয়ান হানড্রেড থাউজেন্ড ডলার। দুটি মিলে বেশ ভালো অঙ্কের টাকা হলো। পরে একটা জায়গা কিনেছি মিরপুরে। আগামী ডিসেম্বরে স্থায়ী ঠিকানায় যাবে আইদেশি।
সামর্থ্যহীনদের জন্য
ইনফেকশাস ডিজিজ নিয়ে কাজ করি। কিন্তু আমার হাজব্যান্ড হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর সংক্রমণ নিয়ে আমার ধারণাটাই বদলে গেল। অটোমেটিক ব্যাকটেরিয়া কালচার, অটোমেটিক মাইক্রোব্যাকটেরিয়াল রেজিস্ট্যান্স কালচারসহ হাসপাতালে একেক সময় একেক ধরনের টেস্ট করা লাগত। একদিন আইসিইউতে বসে ভাবলাম, আমার যেহেতু পরিচয় আছে, সামর্থ্য আছে, টেস্টগুলো করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বলতে পারছি উনার শরীরে এই মুহূর্তে যে ব্যাকটেরিয়া আছে সেটা কোন অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। কিন্তু অনেকেই তো এই টেস্ট করাতে পারবে না। ভাবলাম, বাংলাদেশে যাদের সামর্থ্য নেই এ ধরনের টেস্টিং করানোর, তাদের অনেক উন্নত মানের টেস্টের সুযোগ দেব।
র্যামন ম্যাগসেসাই অ্যাওয়ার্ডে ৩০ হাজার ডলার পাব। সেই টাকা দিয়ে একটা যন্ত্র কিনব। এটা যদি করতে পারি তাহলে এই টেস্টগুলো কম খরচে বাংলাদেশের মানুষ করতে পারবে। অনেকে মানা করছে। কিন্তু আমি এটা করবোই। আমার হাজব্যান্ডের স্মৃতিতে একটা ল্যাব করব আইদেশিতে। উন্নত মানের সরঞ্জাম থাকবে সেখানে।
অবসর নেব না
আমি খুব আশাবাদী মানুষ। ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করি। খুব তাড়াতাড়ি কাজ করি, তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিই। মন থেকে যদি কিছু করতে চাই তাহলে মনে হয় যেন কেউ একজন নির্দেশ দিচ্ছে সেটা করার জন্য। আমার জীবন দর্শন হলো—যত দিন বেঁচে আছি, একটা মুহূর্তও যেন নষ্ট না করি। আমি তো রিটায়ার করব না কখনো। বিশ্বাস করি, লাইফ ইজ গুড। মনে মনে প্রার্থনা করি, যেন কাজ করতে করতে চলে যেতে পারি। যতটুকু পারি দেশকে দিয়ে যেতে পারি। আমি রেখে যেতে চাই কিছু আগামীর জন্য।