সংক্রামক রোগের গবেষণায় পথপ্রদর্শক : ড. ফিরদৌসী কাদরী

সংক্রামক রোগের গবেষণায় পথপ্রদর্শক : ড. ফিরদৌসী কাদরী (bonikbarta.net)

সংক্রামক রোগের গবেষণায় বিশ্বের শীর্ষ বিজ্ঞানীদের একজন ড. ফিরদৌসী কাদরী। ভূমিকা রেখেছেন কলেরার টিকা উন্নয়নে। কাজ করছেন টাইফয়েডের টিকা নিয়েও। বর্তমানে আইসিডিডিআর,বির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক। এশিয়ার নোবেলখ্যাত র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারও আছে এ চিকিৎসাবিজ্ঞানীর ঝুলিতে। অগ্রযাত্রার গল্পের শেষ পর্বটি তাকে নিয়েই। লিখেছেন ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া

বড় কিছু করা কিংবা বিখ্যাত কেউ হওয়ার ভাবনা কখনো ছিল না। তবে দেশের জন্য কাজ করার আগ্রহ ছিল প্রবল। সেই আগ্রহ আজ তাকে জায়গা করে দিয়েছে বিশ্বের শীর্ষ চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের তালিকায়। এত এত প্রাপ্তি ও সাফল্যের পরেও গবেষণায় দাঁড়ি টানেননি ফিরদৌসী কাদরী। বলেছেন, যতদিন বেঁচে আছেন, দেশের জন্য কাজ করে যাবেন।

নিজের বেড়ে ওঠা সম্পর্কে ফিরদৌসী কাদরী বলেন, ‘খুব সাধারণভাবে বেড়ে উঠেছি। এমন ভাবনা ছিল না যে খুব বড় কিছু করব কিংবা বিখ্যাত কেউ হব। দেশের জন্য কাজ করার ইচ্ছে ছিল আর প্রাণী নিয়ে কাজ করতে ভালো লাগত।’

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও হলি ক্রস কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন ফিরদৌসী কাদরী। উচ্চ শিক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে; প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগে। বায়োকেমিস্ট্রি/ইমিউনোলজির ওপর পিএইচডি করেন যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে। পোস্টডক্টরাল করেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) থেকে।

১৯৮৮ সালে আইসিডিডিআর,বিতে যোগ দেন ফিরদৌসী কাদরী। এরপর প্রায় তিন যুগ ধরে সংক্রামক নানা ব্যাধি নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন তিনি। এর মধ্যে কলেরার টিকা নিয়ে ফিরদৌসী কাদরীর কাজ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়। টাইফয়েডের টিকা নিয়েও কাজ করছেন তিনি। তার নেতৃত্বে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে টাইফয়েডের টিকার সফল পরীক্ষা চালানো হয়। ‘টাইফয়েড ভ্যাকসিন এক্সিলারেশন কনসোর্টিয়াম (টাইভ্যাক)-বাংলাদেশ’ নামের এ টিকা বিশ্বের লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচানোর আশা জাগিয়েছে।

বর্তমানে তিনি আইসিডিডিআর,বির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য গঠিত ‘জাতিসংঘ টেকনোলজি ব্যাংক’ ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের ‘সায়েন্স অ্যাডভাইজরি টিমের’ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভাইজরি গ্রুপ অব এক্সপার্টস অন ইমিউনাইজেশন’-এর সদস্যও ছিলেন।

কর্মজীবনে এতটা পথ হাঁটলেও ফিরদৌসী কাদরীর যাত্রার শুরুটা সহজ ছিল না। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘যখন আমি গবেষণায় সময় দিতাম, অনেক সময় পুরুষ সহকর্মীরা প্রশ্ন তুলত, গবেষণায় এত সময় দিলে সংসার কীভাবে চলবে; সন্তানদের কে সময় দেবে?’

যদিও বর্তমানে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে বলে মনে করেন এ চিকিৎসাবিজ্ঞানী। বলেন, ‘আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো নারীর প্রতি ইতিবাচক হয়েছে। ফলে নারী এখন সংসার ও গবেষণা—দুটোই করতে পারছে। এছাড়া এখন নারীর জন্য নানা ধরনের আন্তর্জাতিক তহবিল রয়েছে। ফলে এখন নারীর জন্য গবেষণা সহজ হয়েছে এবং অনেক নারী গবেষণায় আসছে।’ তবে গবেষণার ক্ষেত্রে তহবিল সংকট ও ভালো গবেষণাগারের অভাব রয়ে গেছে বলে মনে করেন এ চিকিৎসাবিজ্ঞানী।

ফিরদৌসী কাদরী মনে করেন, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে রোগতত্ত্ব গবেষণায় বাংলাদেশের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে আমরা বেশ এগিয়ে রয়েছি। ১৩টি রোগের ১১টি টিকা আমাদের ব্যবস্থাপনার মধ্যে রয়েছে। আমরা এ সংখ্যা আরো বাড়াচ্ছি।’

রোগতত্ত্ব গবেষণায় দেশকে এগিয়ে নিতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন এ গবেষক। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণায় বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে। কিন্তু আমাদের দেশে বিনিয়োগ খুবই কম। গবেষণায় এগোতে চাইলে অবশ্যই বিনিয়োগ লাগবে। আমি চাই বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণায় বিনিয়োগ করুক।’

গবেষণায় বিনিয়োগের উদাহরণ তৈরি করেছেন ফিরদৌসী কাদরী নিজেও। ২০১২ সালে ফ্রান্সের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান মেরিয়াক্স ফাউন্ডেশন থেকে একটা পুরস্কারের অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আইদেশী’। বর্তমানে ফিরদৌসী কাদরীর নেতৃত্বে আইসিডিডিআর,বির একদল তরুণ গবেষক এখানে জিনগত ব্যাধি ও এসব ব্যাধির চিকিৎসাপদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য কাজ করছেন। নভেল করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং করে এরই মধ্যে সুনাম কুড়িয়েছেন এসব গবেষক।

নিজের বর্তমান কর্মব্যস্ততা সম্পর্কে ফিরদৌসী কাদরী বলেন, ‘আইদেশী ও আইসিডিডিআর,বি মিলিয়ে অর্ধশতাধিক গবেষণা প্রকল্পের কাজ চলছে।’ ফিরদৌসী কাদরীর ইচ্ছে, যতদিন বেঁচে আছেন, দেশের জন্য কাজ করবেন; রোগতত্ত্ব গবেষণায় বাংলাদেশেকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তরুণদের প্রতিও তার একই পরামর্শ—পথচলাটা যেন দেশের জন্য হয়।

Social Share

Highlights

Scroll to Top